অন্তরে বাস করে যে

Spread the love
সৌমিক চ্যাটার্জী, মুখ্য সম্পাদক, দুবেলা

কোন এক বসন্তের সন্ধে বেলায় মৃদুমন্দ বাতাসের কলরব , কলেজে পড়ুয়া এক ছাত্রী দেখি মাথায় টুপি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। স্বভাব সিদ্ধ খোঁচা মেরে প্রশ্ন করি তাকে – ” ভর সন্ধে বেলায় মাথায় টুপি পরে বোকার মত ঘুরছ কেন ? নাকি এটাই এখন ফ্যশন?” উত্তর আসে ” স্যার , লক্ষ্য করে দেখেছি, ছেলেরা আমার বুকের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। আর সেটা আমি দেখি। বুক লুকনোর পথ নেই, তাই মুখ আর চোখ লুকিয়ে নিয়েছি। মাথা নিচু করে হাঁটি।”

ব্যস্ত চারমাথার মোড়ের হোর্ডিং থেকে ঠিকরে আসে জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের আলো। হীরের নেকলেসের ঝলকানির পেছনে উঁকি মারে অপ্রাসঙ্গিক বক্ষ বিভাজিকা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মহিলা প্লাস্টিক সার্জেনের কাছে প্রশ্ন রাখেন – ” আমার স্তনের আকার ছোট । বিয়ে ভেঙে গেছে। অপরাশেন ছাড়া কি অন্য কোন উপায় আছে ?”

জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেত্রী নীনা গুপ্তা সাংবাদিক কে বলে ফেলেন এক ঘটনা। নব্বই দশকের জনপ্রিয় হিন্দি ছবির পরিচালক তাকে বলেছিলাম শুটিং ফ্লোরে , সবার সামনে- ” তোমার স্তনের গঠন বড়ই ছোট , আইটেম গানের জন্য বেমানান, হয় পুশ আপ ব্রা পর, না হলে অন্য কাউকে দেখতে হবে।” সে গানের কলি ছিল ” চোলি কি পিছে…”। আমরা ছেলেরা , দৈনন্দিন আধুনিকতার চলতি বাসরে তাকে অনেক নামে ডাকি , ডাব, তরমুজ, লিচু , ইত্যাদি। অঙ্গের উপমায় আসে পন্য। আমরা মানুষ, স্তন্যপায়ী জীব।

আধুনিক বিশ্বে নারীর সৌন্দর্যের ধারণা প্রায়শই শারীরিক আকার, চেহারা, রং এবং সৌন্দর্যবোধের উপর নির্ভর করে । ১৯শ ও ২০শ শতাব্দীতে, সৌন্দর্যের কিছু নির্দিষ্ট আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যেমন ছিপছিপে, ফর্সা ত্বক, বড় চোখ, লম্বা পা এবং নির্দিষ্ট স্তন ও নিতম্বের শারীরিক গড়ন।

বিশ্বব্যাপী সৌন্দর্যের এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অনেক নারী নিজেদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যের সাথে তুলনা করতে গিয়ে আস্থা হারান । ফলত, তারা সামাজিকভাবে মূল্যায়িত হওয়ার জন্য এই সৌন্দর্যের মানদণ্ড অনুসরণ করতে বাধ্য হন। মানদণ্ড বজায় রাখতে বাজার তাদের হাতে পন্য তুলে দেয়, তাদেরকে পন্য করে। বাজার নির্ধারিত দেহের গড়ন এবং যৌন আবেদন বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বিক্রির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই প্রক্রিয়া আধুনিক বিজ্ঞাপন এবং মিডিয়ার অন্যতম বড় একটি উপাদান। বিজ্ঞাপন, প্রায়শই নারী শরীরকে বিক্রির উপকরণ হিসেবে দেখায়, যেখানে নারী শুধুমাত্র তার সৌন্দর্য এবং যৌন আবেদনকে বিক্রির উপাদান হিসেবে উপস্থিত থাকে । সামাজিক অবদান থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধুমাত্র একটি শারীরিক বস্তু হিসেবেই তার অস্তিত্ব মানতে রাজি । পরিবার থেকে কর্মক্ষেত্র, গল্প টা বদলায় না। নারী থাকে শরীরে, যৌন আনন্দের বস্তু হয়ে । তার অস্তিত্ব ঢেকে যায় স্তনে। অন্তর্বাসে ঢাকা থাকে , অন্তরে বাস করে যে ।

আঠার শতকের শেষের দিকে, আধুনিক ব্রার ধারণা প্রথম উদ্ভূত হয়। ১৮৯৩ সালে, একজন ফরাসি ডিজাইনার, Herminie Cadolle, প্রথম “ব্রাসিয়ার” শব্দটি ব্যবহার করেন। তিনি একটি বিশেষ ধরনের অন্তর্বাস তৈরি করেন।

বিশ শতকের শুরুতে, যুক্তরাষ্ট্রের ডিজাইনার মেরি পটিস ফ্যাল নামে এক মহিলা, আধুনিক ব্রার ডিজাইন উন্নত করতে সাহায্য করেছিলেন। ১৯১৪ সালে, তিনি প্রথম ‘ফ্যাল’ ব্রা তৈরি করেন, যা সুতির কাপড়ে তৈরি ছিল । ১৯৩০ এবং ১৯৪০-এর দশকে ব্রার ডিজাইন আরও উন্নত হতে থাকে। পুশ-আপ ব্রা, স্পোর্টস ব্রা, লেস ব্রা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের ব্রা বাজারে আসতে থাকে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রা জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে বেশ কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে বড় ভূমিকা ছিল। এসব কারণে মহিলাদের পোশাকের ধরন ও তাদের পোশাক সম্পর্কিত ধারণাগুলি দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে।

যুদ্ধের পর মহিলাদের কাজের ধরনে পরিবর্তন আসে।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, পুরুষদের যুদ্ধের দিকে মনোনিবেশ করতে বলা হয় এবং অনেক মহিলা তাদের জায়গায় কারখানায়, অফিসে এবং অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে কাজ করতে শুরু করেছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে মহিলাদের পোশাকও ছিল কাজের প্রয়োজনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, পশ্চিমা সমাজে নতুন ধরনের ফ্যাশন প্রবণতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৪০-এর দশকে হলিউড অভিনেত্রীদের দ্বারা প্রবর্তিত স্লিম এবং হালকা পোশাকের ধারণা মহিলাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়। ব্রা, বিশেষত পুশ-আপ ব্রা, এই নতুন সৌন্দর্য ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, যা স্তনকে উঁচু এবং আকর্ষণীয় দেখাতে সহায়তা করত। এর ফলে ব্রা একটি জনপ্রিয় পোশাক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৪০-এর দশক থেকে ব্রা নির্মাণকারীরা পণ্যটির প্রচার এবং বিপণনে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করেন। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ব্রা সম্পর্কিত ধারণাগুলি প্রচারিত হতে থাকে। এটি মহিলাদের মধ্যে ব্রার প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব সম্পর্কে একটি নতুন সচেতনতা তৈরি করে। বিজ্ঞাপনে ব্রার ব্যবহারকে একটি ট্রেন্ড এবং ফ্যাশন হিসেবে তুলে ধরা হয়।

জর্জ লুকাচ তার বিখ্যাত গ্রন্থ:-  ” History and Class Consciousness) বইতে false consciousness নিয়ে আলোচনা করেন। তার মতে, false consciousness শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি বা শ্রেণীর ভুল ধারণা নয়, বরং এটি এক ধরনের সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া যা বৃহত্তর সমাজের ভিতরে কাজ করে।

লুকাচের মতে, false consciousness অনেক সময় ধারণাগত অবকাঠামো বা আইডিওলজি এর মাধ্যমে সৃষ্ট হয়, যা শ্রেণীসমাজে শোষক শ্রেণি দ্বারা তৈরি করা হয়। এই আইডিওলজি বা মিথ্যার দৃষ্টিভঙ্গি এমনভাবে শোষিত শ্রেণির মধ্যে প্রবাহিত হয়, যাতে তারা তাদের সমাজ এবং অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি করে। সমাজের শোষিত শ্রেণী নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে সচেতন না হয়ে নিজেদের অবস্থা “স্বাভাবিক” বা অপরিহার্য।

লুকাচের মতে, বুর্জোয়া শ্রেণি বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক ধারণা প্রচার করে, যা শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে false consciousness সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, মিডিয়া, শিক্ষাব্যবস্থা, শিল্প এবং সংস্কৃতি এমনভাবে কাজ করে যাতে শোষিত শ্রেণি নিজেদের পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করতে না পারে। তারা এই ধারণাগুলি গ্রহণ কারণ তারা মানতে শুরু করে যে অবস্থা পরিবর্তন করার ক্ষমতা তাদের নেই ।

নারীর পন্য হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় নিজের অজান্তেই তার যোগদান করার ঘটনা ব্যখা করতে গেলে লুকাচের তত্ত্ব কাঠামো প্রাসঙ্গিক ।

প্লে বয় ম্যাগাজিন ১৯৫৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশক Hugh Hefner। ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সংখ্যায় ছিল মেরিলিন মনরো-এর একটি নগ্ন ছবি নিয়ে।

প্লে বয় ম্যাগাজিনটি শুরু থেকেই বিভিন্ন ধরনের বিতর্কের সৃষ্টি করে এবং এটি যৌনতা, সংস্কৃতি, বিনোদন এবং আধুনিক পুরুষের জীবনধারা সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। প্লে বয় ম্যাগাজিন, নতুন ধরনের যৌন মুক্তি এবং আধুনিক পুরুষের জীবনধারা উপস্থাপন করেছিল।

নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউটি ১৯৬০ এর দশকের শেষের দিকে শুরু হয়। এটি ছিল একটি ব্যাপক সামাজিক আন্দোলন। শ্রমবাজার, যৌন সম্পর্ক, গর্ভধারণের আইনগত অধিকারের দাবী গুলো ছিল সামনের সারিতে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের নারীবাদী আন্দোলনের মূল স্লোগান ছিল “Personal is Political” এই স্লোগানটি ব্যবহার করে, যা একদিকে নারী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার সাথে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিল। তারা নারীদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য, গর্ভপাতের অধিকার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণ, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, এবং যৌন স্বাধীনতার বিষয়গুলোতে কথা বলেছিল।

১৯৬৮, ৭ সেপ্টেম্বর,আমেরিকার নিউ জার্সিতে পথে নামতে দেখা গিয়েছিল যে মহিলাদের, তাঁরা ব্রা-এর বাঁধন থেকে নিজেদের মুক্ত করে তা হাতে নিয়ে মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন।

এই আন্দোলনকে এককথায় বলা হয় ‘বার্ন দ্য ব্রা’ আন্দোলন (Burn the Bra movement)। সহজেই অনুমেয়, ব্রা অর্থাৎ বক্ষবন্ধনী এখানে একটি বন্ধনেরই প্রতীক হিসেবে দেখা হয়েছে। ছয়ের দশকে কিংবদন্তি নারীবাদী জারমাইন গ্রির বলেছিলেন, ”ব্রা একটি হাস্যকর উদ্ভাবন।” এই কথাটিই যেন হয়ে উঠেছিল ১৯৬৮ সালের আন্দোলনের মূলমন্ত্র।

ভিতরে ভিতরে বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা কতটা প্রবল হয়ে উঠেছিল সেদিনের মার্কিন নারীদের। ‘Personal is Political ’ অর্থাৎ ‘ব্যক্তিগতই রাজনৈতিক’ কথাটা হয়ে উঠেছিল একটা বার্তা।

এই আন্দোলনের জন্য তাঁরা বেছে নিলেন সেই বছরের ‘মিস আমেরিকা’ প্রতিযোগিতাকে। আমেরিকার দুই-তৃতীয়াংশ টিভিতে সেই সময় ওই অনুষ্ঠানই চলছিল। নারীবাদীরা দেখলেন এটাই সঠিক ইভেন্ট, তাঁদের প্রতিবাদ দেখানোর জন্য। আন্দোলনকারীদের অধিকাংশেরই বয়স কুড়ির ঘরে কিংবা তিরিশের একেবারে গোড়ায়। কিন্তু তাঁদের সঙ্গেই তাঁদের মা-ঠাকুমারাও পা মিলিয়েছিলেন মিছিলে।

একটি ভেড়াকে ‘মিস আমেরিকা’ সাজিয়েও মিছিলে নিয়ে আসা হয়েছিল। মহিলাদের নিছক ‘মাংস’ তথা ‘সেক্স অবজেক্ট’ হিসেবে ব্যবহার করার প্রতিবাদ হিসেবেই ভেড়ার অবতারণা। দেখা গেল মহিলারা তাঁদের ব্রা খুলে পোশাকের আড়াল থেকে বের করে এনে হাতে নিয়েই হাঁটছেন মিছিলে। তারপর একসময় সেগুলি তাঁরা ছুঁড়ে ফেলতে লাগলেন ‘ফ্রিডম ট্র্যাশ ক্যানে’।

২০১৮ সালে ‘এস্কেপ দি কর্সেট'( Escape the Corset) নামের আন্দোলন হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়াতে । মহিলারা তাদের লম্বা চুল কেটে ফেলেন এবং প্রসাধনী ছাড়া বাইরে বের হতে শুরু করেন। সেসব ছবি তারা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন।

এই আন্দোলনের মূল শ্লোগানটি এসেছিল নারীদের অবাস্তব সৌন্দর্য চর্চার বিরুদ্ধে, যে চর্চ্চা করতে গিয়ে নারীরা মেকআপের পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন।

১৯০৮ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কে পোশাক শ্রমিক ইউনিয়নের নারীরা কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত শ্রম ও শিশুশ্রম বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।

 ১৯১০ সালে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ক্লারা জেটকিন প্রস্তাব করেন যে, প্রতি বছর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী শ্রম দিবস হিসেবে পালিত করা হোক। তবে আমরা প্রতি বছর ৮ মার্চ কে বেছে নিয়েছি আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের জন্য। মাঝখান থেকে ‘শ্রম’ শব্দটি উবে গেছে। কোন আজানা কারণে।

Related posts

Leave a Comment