
দুবেলাঃ সবারই ছুটির প্রয়োজন। প্রত্যেকের জীবনে একটা ছুটির দিন আসে, চিরকালের মত। ক্লাসরুমের রোজ নামচা, মিছিল মিটিং আর ট্র্যাফিক জ্যামের শহরে যখন দম বন্ধ লাগে, মনে হয় ছুটি নিয়ে ফিরে যাই গ্রামে। আবার নতুন করে শহরে ফিরে আসার জন্য।
ক্ষণিকের ছুটির বড় দরকার পড়ে, চিরকালের ছুটিকে আর একটু পিছিয়ে দিতে। আমার পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা গ্রামে জীবন আছে, আর ক্যাকাফোনির শহরে জীবিকা। একদিকে পরিবার, অন্য দিকে পেশা। সেদিন আমার জীবনে ফেরার দিন, শহর ছাড়ার দিন। তবে কদিন ধরেই মেজাজ বিগড়ে আছে । কারণ সংগত। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি গেছে 2016 সালে নিয়োগ হওয়া স্কুল শিক্ষকদের।
আমরাও সান্ধ্য বাসরে আলোচনা করার যুতসই বিষয় পেয়ে গেছি। তথ্য সহ যুক্তি তর্কে উত্তাপ বাড়াচ্ছে টেলিভিশনের প্রাইম টাইম। ওয়াকফ বিলের ময়না তদন্ত থেকে এ বঙ্গে রাম জন্মোৎসব পালন; পারদ চড়ছে, শহুরে মেজাজের: ধীরে ধীরে ভিড় জমছে ইলেকট্রনিক সরঞ্জামের দোকান গুলোয়, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র কিনতে। ঠান্ডা হওয়ার যোগাড় করছে শহর। এই ভ্যাপসা আবহাওয়ায়, আমার গ্রামে ফেরার ট্রেনের বাতানুকুল কামরার টিকিট শেষ অবধি কনফার্ম হতে হতেও হলনা। সাধারণত এসময়ে ট্রেনে এতটা চাপ থাকেনা।
অতঃপর তৎকালে স্লিপার বগিতেই আমার ঠাঁই হল। আমি মনে মনে সেই সব অসময়ের পর্যটকদের অভিশাপ দিয়ে উত্তর বঙ্গ এক্সপ্রেসের স্লিপার বগিতে চড়ে বসলাম ব্যাজার মুখে। প্যাচ প্যাচে গরমে। স্টেশনে আসতেও দেরি হয়েছিল সেদিন কারণ চাকরি হারা শিক্ষকদের মিছিল বেরিয়েছিল শহরে। ট্রেনে উঠে মনে হল শরণার্থী শিবিরে ঢুকেছি। মাছি গলার জায়গা নেই। ছয় জনের জায়গায় দশ জন বসে। তার মধ্যে আরও তিনজন হন্ত-দন্ত হয়ে উঠলেন। তার মধ্যে একজন আমাকে এসে অনুরোধ করলেন,” দাদা একটু বসতে দেবেন, আমরা বর্ধমান, বোলপুরে নেমে যাব, দুটো টিকিট কনফার্ম হয়েছে, তবে তিনজন আছি”। আমি নিজের জায়গা যতটা সম্ভব রক্ষা করে ওদের সামান্য জায়গা করে দিলাম। ট্রেন ছাড়ল।
ওরা তিনজন, অসিত দলুই (নাম পরিবর্তিত), শুভ্রা দত্ত (নাম পরিবর্তিত) শৌভিক কুণ্ডু (নাম পরিবর্তিত)। এর মধ্যে অসিত বাবুর টিকিট কনফার্ম নয়। আমি বললাম ‘ এটা তো রিজার্ভ বগি, টিকিট চেকার তো আপনাকে বসতে দেবে না” অসিত বাবু বললেন ” চাকরি টা তো গেছে, আর সিটের মায়া করিনা, অনুরোধ করব, যদি বসতে না দেয়, দাঁড়িয়ে চলে যাব “। ইতিমধ্যে শুভ্রা ম্যাডামের আই ফোন টি বেজে উঠল। উনি ফোনের ওপারে কোন ব্যক্তিকে বোঝালেন যে চাকরি ফিরে পাওয়ার কোন আশা নেই। এই মাসের শেষে বেতন হবে না। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সভায় কোন সমাধান সুত্র উঠে আসেনি। ট্রেন তখন বালি ব্রিজ পার করছে।
আমার আশঙ্কা ক্রমশ সত্যি প্রমান হল , আলাপচারিতায়। শুভ্রা দত্ত, বিশ্ব ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এড করে 2016 সালে বর্ধমানের একটি স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। সেই সময় তিনি টাটা ইন্সটিটিউট অফ সোসাল সায়েন্সে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সেটি তিনি ছেড়ে দেন। কারণ স্কুল শিক্ষকের স্থায়ী সরকারী চাকরিটি পেয়েছিলেন। ওনার স্বামী হুগলির একটি বেসরকারী বি এড কলেজের অধ্যাপক। ওনাদের সন্তানের বয়েস তিন বছর। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ওনার শিক্ষকতার চাকরিটি চলে গেছে । চাকরিহারা শিক্ষকদের প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিতে কলকাতায় এসেছিলেন। বর্ধমানে থাকেন।
অসিত দলুই, বোলপুরের একটি সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। নিয়োগ হয় 2016 সালে। ওনার স্ত্রীও শিক্ষক। 2014 সালে প্রাথমিকে নিয়োগ পান। 2016 তে স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রামপুরহাটের একটি মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ে চাকরি করতে শুরু করেন আগেরটি ছেড়ে। ওনাদের দুটি সন্তান। ছেলে ছয় বছর, মেয়ের বয়স আট মাস। অসিত বাবু মাসে চল্লিশ হাজার টাকা শুধুমাত্র লোন শোধ করেন। জমি কিনে বাড়ি বানিয়েছিলেন। বাড়িতে ওনারা চারজন ছাড়াও, ওনাদের উভয় পক্ষের বাবা মায়েরা থাকেন। তাদের সবার বয়স আনুমানিক পঁচাত্তর পেরিয়েছে।
অসিত দলুইও ওনার স্ত্রী দুজনেই কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজের স্নাতক, ইংরেজি সাহিত্যে। পরে দুজনেই ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি এড পাশ করেন। আজ ওনারা দুজনেই বেকার। বাচ্চাদের দেখা শোনা করার জন্য অসিত বাবুর স্ত্রী বাড়িতে আছেন আর অসিত বাবু কলকাতায় এসেছিলেন শিক্ষকদের ধর্নায় যোগ দিতে।
আরও পড়ুনঃ RBU স্বর্ণপদক প্রাপ্ত শিক্ষিকারও চাকরি বাতিল
শৌভিক কুণ্ডু, আশুতোষ কলেজের স্নাতক। বিষয় বটানি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনেটিক্সে স্নাতকোত্তর। হেস্টিংস কলেজ থেকে এম এড শেষ করেন। নলহাটির একটি মাধ্যমিক স্কুলের জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক। ওনার স্ত্রী ও শিক্ষক বোলপুর হাই স্কুলের। বিষয় জীবন বিজ্ঞান। আশুতোষ কলেজে দুজনের আলাপ। বাকি লেখাপড়া হেস্টিংস কলেজ পর্যন্ত, একসাথে। তার পর প্রেম ও পরিনয়। ওনাদের এক মেয়ে, বয়স তিন মাস। দুজনেই 2016 সালের এস এস সি দিয়ে চাকরি পান। আজ ওনারা দুজনেই বেকার। শৌভিক বাবু আমাকে ওনার মোবাইল ফোন থেকে কয়েকটি হিসেব দেখালেন। সুপ্রিম কোর্টে শিক্ষকদের হয়ে মামলা লড়ার খরচ। প্রত্যেকেটি হাজিরায় আনুমানিক আশি লক্ষ টাকা। উকিল দের তালিকায় আছে কপিল সিব্বল, অভিষেক মনু সিংভির নাম। কপিল সিব্বল প্রতি হাজিরায় চোদ্দ লক্ষ টাকা নিয়েছেন। শৌভিক বাবু বললেন আমায় “দাদা, এই ট্রেনে আজ আমাদের মত কয়েক হাজার ছেলে মেয়ে আছে, আমাদের সবার ছুটি হয়ে গেছে। আমরা সবাই বাড়ি ফিরছি। “
আমাদের ছুটি হওয়া গুলো খুব আকস্মিক। তাই না?…