
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মিচেল ক্যামেরা কোম্পানি জন্ম নেয় ১৯১৯ সালে। তার আগের বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। রুপকলা কেন্দ্রের ডিপার্টমেন্টের বাইরে মুর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ৭০ মিলিমিটারের মিচেল ক্যামেরাটার গায়ে হেলান দিয়ে ততক্ষনে একটা সেলফি তুলে নেওয়া যাক। স্যার আসতে সময় নেবেন। বয়েস হয়েছে। যতই হোক, অপু আর দূর্গাকে তো সেই প্রথম দেখেছিল, দেখিয়েছিল। সমাজ মাধ্যমে সেলফি টা দিতেই অবাক করা ইমোজিদের মিছিল। এতক্ষনে বুড়ো সৌমেন্দু স্যার এলেন বাইরে। সৌমেন্দু রায়।
আমার কনটিনিউটির গল্পটা কি ভাবে এডিট করব সে বিষয়ে পরামর্শ নিতেই ওনার শরনাপন্ন হওয়া। সত্যজিতের ক্যামেরা ম্যান। সব ফেলু মিত্তিরেরই একজন সিধু জ্যাঠা লাগে, আটকে গেলে। নব্বই ছুঁই ছুঁই সৌমেন্দুদা মিচেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন আমার সমস্যা শুনে, কিছুক্ষণ। সমাধান দিলেন। বাঁকা সময়, ডিজিটাল বিশ্বে গল্প টা নন লিনিয়ার হোক। সিনেমার জাত বজায় থাকে তাতে।
“কোথায় এলাম রে ?” কাশ বনের গায়েপড়া রেললাইন দেখে দিদিকে এই প্রশ্ন টাই করেছিল অপু। উত্তর ছিল তাতে – প্রযুক্তির কাছাকাছি সে আসতে চেয়েছিল । না হলে আধুনিক হবে কি করে ? কলাভবনের মানিকবাবু তাই ঠিক করলেন ক্যামেরা দিয়েই কথা বলবেন। ১৯২১ সাল, সে বছর ধরাধামে সত্যজিত এলেন। আর মার্কিন সমাজতাত্বিক থার্স্টেইন ভেবলেন এক খানা বই লিখলেন- “The Culture of Technology”। সেখানেই জুড়ে দিলেন এক জটিল শব্দ বন্ধ- “Technological Determinism”। প্রযুক্তিগত নির্ধারণবাদ সময় যত গড়িয়েছে, আধুনিকতা ও মুল্যবোধের দন্দ্ব ততই আরও আঁচড় কেটেছে মানিকবাবুর খেরোর খাতায়। ফুটে উঠেছে বিমলা, চারু , সর্বজায়া, আরতি, অনিলাদের অস্তিত্ব সংকট।
১৯৮০ হীরক রাজার নির্মাণ বুঝিয়ে দিল আধুনিকতার নামে রাষ্ট্র, ক্ষমতা আর প্রযুক্তির শয়তানির ইকুয়েশন। গ্রামের ছেলে গুপি গাইলেন ” নহি যন্ত্র, নহি যন্ত্র আমি প্রাণী”। বললনে সত্যজিত। সিনেমার বাস্তবতা মুক্তি দিল বর্তমানের নবজাতকদের, আধুনিকতার যন্তর – মন্তর ঘর থেকে। আমাদের বাস্তবতার রঙ্গ তখনও বিদ্যমান। অবাক হওয়া বাকি। স্বৈরাচারী হীরক রাজার মূর্তি টুকরো হয়েছিল গণজোয়ারে। তখনও নগর সমাজ চিনতে পারেনি উন্নয়নের সীমাবদ্ধতা। চিনতে পারেনি দুই প্রতিদ্বন্ধী কে, আমি বনাম আমি। ফলত সম্পর্কের শাখা প্রশাখারা যে বুড়িয়ে যাবে, অচিরেই মুড়িয়ে যাবে তাদের চিরহরিত ডালপালা, আধুনিক দিন যাপনের স্বার্থে, ভবিষ্যতের এই সমাপতন তো জানাই ছিল। এই আধুনিক গণসমাজের নির্মাণ যে গণশত্রুদের হাতে। এই মহানগরে বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন বেশী মূল্যবোধ আর চেতনার থেকে। এখানে রাষ্ট্রের নির্ধারণ করে দেওয়া পরিচয় বহাল থাকে। পাসপোর্ট জিতে যায়, হেরে যায় মন । বর্বরতা আর সভ্যতার বাইনারিতে জড়িয়ে পড়ে মানুষ, টিকে থাকে অশনী সংকেতে। প্রযুক্তি আর অন্ধ বিশ্বাসের সহাবস্থান রহস্যময়। কিন্তু এই রহস্যের কিনারা করতে সত্যান্বেষীও অপারগ। এই আজব চিড়িয়াখানায় আমরা থাকি, এখানে দূরবীন দিয়ে মেপে নিতে হয় অনুভূতির গভীরতা। সারল্যের লালমোহন বাবুরা, এখানে নেহাতই অপাংতেয়। সত্যজিত দেখিয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দারিদ্র্যের প্রেক্ষাপটে তৈরি ইতালির পরিচালক ভিত্তোরিয় দেসিকার বাইসাইকেল থিব্স্ ছিল সত্যজিতের সিনেমা তৈরির অনুপ্রেরণ। বাস্তবতার দৃশ্যায়ন আর সিনেমার বাস্তবতাকে মিলিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ছিল সত্যজিতের শিল্পী সত্ত্বার রাজনীতি। মানুষ গুরুত্ব পেয়েছে তার ফ্রেমে। চরিত্র হয়ে উঠেছে নির্জন কাঞ্চনজংঘা। প্রযুক্তি নির্ধারিত আধুনিকতা যা যুদ্ধের জন্য মারনাস্ত্র তৈরি করে, ধ্বংসের পক্ষে থাকে, তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে প্রান্তিক গুপি বাঘা। মার্ক্স, বঙ্কিম,শেক্সপিয়ার, ফ্রয়েড পড়া ভূপর্যটক মনমোহন মিত্র জীবন সায়ান্হে এসে আক্ষেপ করেন “আমি জংলি নই। আলতামিরার গুহাবাসিদের মত বাইসন আঁকতে পারি না, এটা আমার কাছে পরম আক্ষেপের। ” শহুরে, মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে তাই সে আগন্তুক।
১৯৯১ সালের মে মাসে মুক্তি পায় আগন্তুক। National Film Development Corporation এর প্রযোজনায়। সেই বছরই ফেব্রুয়ারি মাসে পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ ( Gulf War) শেষ হয়। আনুমাকি পঞ্চাশ হাজার মানুষ মারা যান এই যুদ্ধে। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে ভারত সরকার অর্থনৈতিক উদারিকরেণর নীতি গ্রহন করে। ঠান্ডা যুদ্ধ ( Cold War) শেষ হয় আর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। পর্দার আগন্তুক, মনমোহন মিত্র বলে চলেন “সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ যে আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে, একটি ব্রক্ষ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমগ্র অধিবাসী সমেত একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর সভ্য হল তারা যারা এই অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, without turning a hair (অবলীলায়)।”
১৯৯২ সালে সত্যজিত মারা যান। টেলিপ্যাথি কিনা জানিনা একশ বছর বয়েস হল তাঁর। তিনি এখনও প্রাসঙ্গিক। কারণ আমরা এখনও জলসাঘরের ধ্বংসস্তুপে পরশপাথর খুঁজে চলেছি, ভাল থাকার।
Photo Courtesy: mashindia.com