সরোবন থেকে শাহবাগ

Spread the love
সৌমিক চ্যাটার্জী, মুখ্য সম্পাদক,        দুবেলা

22 শে মার্চ 1968, প্যারিসের নান্তের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখান কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন চলে যায় ছাত্রদের দখলে। আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে প্যারিস শহরে। 3 রা মে সরোবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগঠিত মিছিল করে আন্দোলনকারী ছাত্ররা। সেই মিছিলে গুলি চালায় ফরাসী পুলিশ। আন্দোলন ছত্রভঙ্গ করতে চলে কাঁদানে গ্যাস গ্রেফতার করা হয় ছাত্রদের। ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হয়ে যায় সরোবন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। আন্দোলনের মূল দাবী ছিল শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । আন্দোলন ছিল বেকারত্ব, শ্রমিক শোষনের বিরুদ্ধে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। ন্যায়বিচারের পক্ষে।ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয় শ্রমিকরা। 13 ই মে শ্রমিক সংগঠনগুলি দেশ জুড়ে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। ধর্মঘটে অংশ নেয় প্রায় এক কোটি শ্রমিক। ক্রমশ এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, দেশান্তরে।

1 লা জুলাই 2024। উত্তাল হতে শুরু করে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ,কলেজ ক্যাম্পাস গুলো। সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণের প্রতিবাদে রাস্তায় নামে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ। আন্দোলনের গণদাবী ছিল – মেধার ভিত্তিতে কাজ, কোটার ভিত্তিতে নয়। যদিও এই কোটা বিরোধী আন্দোলনের শুরু 2018 সালে। 8 ই এপ্রিল কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু হয় ঢাকার শাহবাগ থেকে। আন্দোলনকে সংগঠিত করে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংগঠন। আন্দোলনের চাপে তৎকালীন আওয়ামীলীগ পরিচালিত শেখ হাসিনা সরকার সংরক্ষণ সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রত্যাহার করতে একরকম বাধ্য হয় ।

কি ছিল সেই সংরক্ষণ নীতি ? সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে 56% সংরক্ষণ নিয়ন্ত্রন করবে সরকার। 30% সংরক্ষণ থাকবে মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য। 10% সংরক্ষণ থাকবে অনগ্রসর জেলার বাসিন্দাদের জন্য। 10% সংরক্ষিত থাকবে মহিলাদের জন্য। আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য 5% ও বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের 1% সংরক্ষণ থাকবে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে। বাকি 44% নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে।

2021 সালে 7 মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশ হাইকোর্টে আপিল করেন কোটা ব্যবস্থা পূনর্বহাল করার দাবী জানিয়ে। বলাই বাহুল্য এই মামলা দায়ের করার পেছনে ছিল সাম্রাজ্যবাদী শাসকের কূটনৈতিক চাল। 5 ই জুন 2024, বাংলাদেশ হাইকোর্ট রায় দেয় মামলাকারীদের পক্ষে। হাইকোর্ট সরকারকে নির্দেশ দেয় প্রত্যাহার করা নির্দেশিকাকে পূনর্বহাল করতে। কোটা ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে। 16 ই জুলাই ঢাকায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও সরকার পন্থী ছাত্র লীগের সংঘর্ষে নিহত হন 6 জন। দেশে জারি করা হয় কমপ্লিট শাটডাউন। কোটা প্রত্যাহার ও হাসিনার পদত্যাগের দবীতে অগ্নিগর্ভ হয়ে বাংলাদেশ। জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বিবৃতি দিতে গিয়ে আন্দোলন কারী শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে উল্লেখ করেন । দেশে সেনা নামে , কার্ফু জারি করা হয়। ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় । রাষ্ট্র যন্ত্রের প্রয়োগে যতূগৃহের চেহারা নেয় গোটা দেশ। অবলীলায় চলে হত্যা। 36 দিন চলা আন্দোলন সরকারী সুত্র অনুযায়ী মৃত্যুর সংখ্যা 300। আহতের সংখ্যা তিন হাজারের বেশী। পঁচিশ হাজার ছাত্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র দ্রোহের মামলা দায়ের করে বাংলাদেশের আওয়ামীলীগ সরকার। 21 শে জুলাই, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট সরকারি চাকরিতে 93% মেধা ভিত্তিক নিয়োগ ও মুক্তিযোদ্ধা সহ বাকি ক্ষেত্রে 7% সংরক্ষণের নির্দেশ দেয়।

সরোবন এর ছাত্র আন্দোলন কে প্রথম দিকে গুরুত্ব দেয়নি রাষ্ট্রপতি শার্ল দে গলের নেতৃত্বে থাকা ফরাসী সরকার। যেমন কোটা আন্দোলনকে গুরুত্ব দেয়নি হসিনা সরকার। ফ্রান্সের আপাতক্ষীন গণআন্দোলন ফলপ্রসু রাষ্ট্রপতি শার্ল দে গল পদত্যাগ করেন। দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন যে গণ আন্দোলনের চেহারা নিল, তার অংশীদার শুধু ছাত্ররা নয়। তাতে জুড়ে গেছেন জাহাঙ্গীরনগরের রিকশা ওয়ালা মামারা, সমস্ত প্রান্তিক শ্রেনীর মানুষ। বঞ্চিত জনতা। ঠিক প্যরিসের মত। 5 ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু মুজিব কন্যা ,শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী পদে ইস্তফা দিয়ে ছাড়লেন বাংলাদেশ। ইতিহাস ফিরে আসে মানবতার স্বার্থে। সময় তাই বলে। সরোবনের তরঙ্গ ধাক্কা মেরেছিল আধুনিক পুঁজিবাদের বুকে। সামগ্রিক ভাবে। প্যরিসের ছাত্ররা , সুশীল সমাজ, শ্রমিকরা যে বিকল্প সমাজ ভাবনা সঞ্চার করেছিল ইতিহাস তা আজও মনে রেখেছে।

সরোবনের পথ অনুসরণ করেছিল শাহবাগ। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এই বিকল্প বিপ্লবে ভয় পেতে বাধ্য হবে পৃথিবীর আনাচে কানাচে থাকা ক্ষমতার এক নায়করা সে কথা ঠিক। তবু এ আখ্যানের শেষ দৃশ্য খুব আশাব্যাঞ্জক নয়। মুজিব কে হীরক রাজা বলা চলেনা। তাতে ইতিহাস বিকৃত হয়। গণ ভবনে উন্মত্ত জনতার কলরব আফগানিস্তান বা শ্রীলঙ্কার মত ডিপ স্টেটের ভাবনাকে উস্কে দিচ্ছে। উস্কে দিচ্ছে মৌলবাদ, জাতিবিদ্বেশ পূনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকেও । শাহবাগ সীমানা ছাড়িয়ে কতটা সরোবন হতে পারবে মানবতার পক্ষে তার উত্তর ও সময়ের কাছে রাখা। সদুত্তরের রসদ আছে, প্রয়োজন সঠিক অভিমুখের।

Image courtesy: https://commons.wikimedia.org/wiki/File:4.Bangladesh_quota_reform_movement_2024.jpg

Related posts

Leave a Comment