
দুবেলা: জগৎ এ দুঃখ প্রধানত চার প্রকারের – জন্ম, মৃত্যু, জরা, এবং ব্যাধি। তবে কিনা রাজকুমার সিদ্ধার্থ এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। তিনি কেবল জানতেন যে রাজমহলের আতিশয্য, বিত্ত, বৈভব, সুখ এবং ভোগ এই বুঝি জীবনের সারবস্তু। কিন্তু এর জন্য তো তাঁকে দোষ দেওয়া যায়না। তাঁর পিতা নেপালের কপিলাবস্তুর মহারাজ শুদ্ধোধন তো সর্ব প্রকারের ব্যবস্থা করেছিলেন যাতে সে জীবনের পরম সত্য দুঃখ কোনোদিন ও অনুভব করতেই না পারে।
জন্মের পর রাজ জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে হয় এই বালক এমন সম্রাট হবে যে তাঁর সাম্রাজ্য দেশ-কালের সীমা অতিক্রম করবে, অথবা সন্যাসী হবে। প্রথমটি নিয়ে রাজা শুদ্ধোধনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কোনো সীমা ছিল না, তবে দ্বিতীয়টি নিয়ে তিনি যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। বংশের ভবিষ্যত রাজা যদি সন্যাসী হয়ে যায়, তবে রাজত্ব কে সামলাবে? বিরাট বিপদ। তাই রাজা ব্যবস্থা করলেন যেন খাদ্য, বস্ত্র, আমোদ-প্রমোদ কোনো কিছুরই অভাব সিদ্ধার্থের না হয়। মাত্র ষোলো বছর বয়সে যশোধরা নাম্নী রাজকুমারীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। সব কিছু যাচ্ছিল ভালোই, তবে কিনা আমোদ-প্রমোদ ও যখন তার সীমা অতিক্রম করে যায় তখন তো বিষবৎ মনে হতে থাকে। কোনো দিনও রাজমহল থেকে না বেরোনো সিদ্ধার্থের মন আকুল হয়ে ওঠে বাইরে জগতকে দেখবার জন্য। কিন্তু বাইরে যাওয়া নিষেধ। অতএব রাজসারথীকে গোপনে অনুরোধ করে একদিন বেরোবার আয়োজন হলো। রথে চড়ে সিদ্ধার্থের যাত্রা শুরু হলো।
বাইরে প্রচুর মানুষের সমাগম, ধনী-দরিদ্র, স্ত্রী-পুরুষ, উঁচু জাত-নিচু জাত, ইত্যাদি। কোথাও প্রচুর কোলাহল, তো কোথাও প্রচুর শান্তি।
কিন্তু এই সব কিছুই সিদ্ধার্থকে স্পর্শ করে না।
তাঁর চোখ প্রথম আটকায় এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে দেখে। সিদ্ধার্থ আগে কোনদিন ও বার্ধক্য দেখেনি, সে দেখেছে কেবলই তারুণ্য। সারথিকে তাঁর প্রথম প্রশ্ন – “ইহা কি?”। সারথী উত্তর দেয় – “কুমার, এ হলো বার্ধক্য। দেহ শৈশব, যৌবন অতিক্রম করে বার্ধক্যে এসে উপনীত হয়।”
-“তারমানে, আমার ও একদিন বার্ধক্য আসবে?”
-“হ্যাঁ কুমার, আমার আপনার সবারই আসবে।”
রথ ক্রমশঃ এগিয়ে চলতে থাকে, এবার সিদ্ধার্থের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক অসুস্থ শীর্ণকায় ব্যক্তি। সে প্রশ্ন করে – “ইহা কি?” সারথী উত্তর দেয়, – “কুমার, এ হলো ব্যাধি। শরীর রোগগ্রস্ত হলে এই প্রকার অবস্থা হয়।
-“আমারও হবে?”
-“হ্যাঁ কুমার। দেহের উপস্থিতিই ব্যাধির আমন্ত্রণ।”
রথ আরো এগিয়ে চলে, এবার সিদ্ধার্থের চোখ আটকায় একটি মৃতদেহ দেখে। সে আবারও প্রশ্ন করে, – “ইহা কি?”
-“ওটি একটি মৃতদেহ কুমার। জীবন শেষ হবার পর দেহ ওই অবস্থা লাভ করে।”
-“আমারও হবে, বুঝি?”
-“হ্যাঁ কুমার। আপনারও হবে, আমারও হবে। আমরা সবাই একদিন মারা যাবো।”
জগতে এই প্রকার দুঃখের উপস্থিতি যা আগে জানা ছিল না, রাজকুমার সিদ্ধার্থকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়। রাজমহলের ফিরে আসার পরও, দিন রাত এই সকল দৃশ্য তাঁকে গ্রাস করতে থাকে। এর সমাধান সন্ধান যেন অত্যন্ত আবশ্যক। রাজ মহলের সকল আমোদ-প্রমোদ সব ব্যর্থ মনে হতে থাকে তার কাছে।
এর পর আরও একদিন সারথীর সঙ্গে তার যাত্রা হয়। হঠাৎ একদিন এক সন্যাসী দেখে সিদ্ধার্থ সারথীকে রথ থামিয়ে প্রস্ন করে –
-“আচ্ছা, এই লোকটির মুখে এরকম এক পরিচ্ছন্ন আনন্দ কেনো? এই জগতে এতো দুঃখ থাকা সত্বেও যেন এর কোনো চিন্তাই নেই। এরকম কেনো?”
সারথী উত্তরে বলে, “কুমার, উনি সংসারে সমস্ত আনন্দ আর ভোগের ইচ্ছা ত্যাগ করেছেন, এই জন্যই দূঃখ ও ওনাকে স্পর্শ করতে পারে না।”
আরও কিছু দূর গিয়ে ধ্যানরত এক ব্যক্তিকে দেখে সিদ্ধার্থ প্রস্ন করে, “ইনি কে?”
-“উনি একজন তপস্বী কুমার। উনি তপস্যার মাধ্যমে জীবনের জটিল প্রশ্নের সমাধান খোঁজেন জগতের কল্যাণ সাধনের জন্য। উনি সেই জ্ঞানের দৃষ্টি অর্জনের চেষ্টা করছেন যাতে জগৎ পরিবর্তনের প্রভাবকে জয় করতে পারেন।”
রাজমহলে ফিরে আসার পরে সিদ্ধার্থ আরো গভীর চিন্তা করতে থাকে। অবশেষে একদিন রাতে, মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে, স্ত্রী ও পুত্র রাহুলকে শেষ দেখা দেখে পিছন ফিরে না তাকিয়ে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করলেন। উদ্দ্যেশ্য, তপস্যা, জগতের দুঃখ নিবারণের জন্যে সত্যের অনুসন্ধান।
উনপঞ্চাশ দিন বোধী বৃক্ষের নিচে কঠোর তপস্যার পর, সত্যের উপলব্ধি হলো তার। সিদ্ধার্থ হলেন গৌতম বুদ্ধ।
হ্যাঁ, বুদ্ধ, যিনি জন্ম মৃত্যু, জরা ব্যাধিময় জগৎ থেকে দুঃখের উপশমের জন্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের নিদান দিলেন বিশ্বকে। যেগুলি হলো – ১. সৎ দৃষ্টি ২.সৎ চিন্তা ৩. সৎ সংকল্প ৪. সৎ বাক্য ৫. সৎ কর্ম ৬. সৎ জীবন যাপন ৭. সৎ প্রচেষ্টা এবং ৮. সৎ মনোযোগ।
বুদ্ধ তাঁর সম্পূর্ণ জীবন উৎসর্গ করেন মানব কল্যাণের জন্য। তিনি সন্যাসী এবং গৃহস্থ উভয়ের জন্যই অষ্টাঙ্গিক মার্গের নিদান দেন। তাঁর সম্পূর্ণ জীবনে তিনি বহুবার তথাকথিত উপাচারে নিবিষ্ট বৈদিক ব্রাহ্মণদের তর্কে পরাজিত করেন। তাঁর বহু শিষ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন দস্যু অঙ্গুলিমাল এবং বেশ্যা আম্রপালি।
বুদ্ধ আবারো একবার তাঁর জন্মস্থান কপিলাবস্তুতে ফিরে আসেন। তাঁর পিতার মৃত্যু শয্যার তাঁকে শেষ দেখা দেখতে। শেষবার নিজের পুত্রকে দেখে রাজা উপলব্ধি করেন যে রাজজ্যোতিষীর দুটি ভবিষ্যদ্বাণী একসাথে ফলে গিয়েছে।
এক দেশ-কালের উর্ধ্বে ওঠা মানুষের হৃদয়ে রাজত্ব করা সম্রাট সন্যাসী সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধকে সামনে দেখে তিনি প্রাণ ত্যাগ করেন। পত্নী যোশোধরা এবং পুত্র রাহুল বুদ্ধের শিষ্যত্ব গ্রহন করে তাঁর সাথেই পরিব্রাজনে বেরিয়ে পড়েন। কিছুদিন কপিলাবস্তুতে থাকার পর তিনি সারনাথ চলে আসেন, তারপর আশি বছরের বুদ্ধ নেপালের কুশীনগরে এসে সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি অন্ন জল ত্যাগ করে স্বেচ্ছা মৃত্যু বরণ করবেন। এই ভাবে তিনি অন্তিম সমাধি প্রাপ্ত হন।
কবি জয়দেব তাঁর “গীত গোবিন্দম” রচনায় বুদ্ধকে বিষ্ণুর নবম অবতার বলে বর্ণনা করেছেন।
আর এই একবিংশ শতাব্দীতে আমরা আজও ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে তাঁর মূর্তির সামনে পুষ্প এবং সুগন্ধি জ্বালিয়ে মাথা নত করে থাকি, আর মনে মনে বলি – বুদ্ধং স্মরণম গচ্ছামি!