হোলি কা দহন: অহং ঢাকে রঙে

Spread the love
সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় (অধ্যাপক, কাশীপুর জৈন কলেজ)

দুবেলাঃ “হোলি হ্যায় ভাই হোলি হ্যায়, বুরা না মানো হোলি হ্যায়!” (তোমার গায়ে রং লাগালে খারাপ ভাবে নিও না, কারণ আজ হোলি)। শোলে ছবির সেই দৃশ্যটি মনে আছে যেখানে তরুণী জয়া ভাদুড়ি সঞ্জীব কুমারকে রং নিয়ে তাড়া করছেন, যিনি গরুর গাড়িতে চড়ে তার গ্রামে ফিরছিলেন? অবশ্যই, এই সম্পর্কে খারাপ লাগবেই বা কেন? কিন্তু আমি যখন বড় হয়েছি তখন আমার এই বিষয়ে অন্যরকম ধারণা তৈরি হয়েছে- কেন খারাপ লাগবে না? এই দিনে অনেক খারাপ ঘটনাও ঘটে কিনা! কিছু মানুষ অশালীন, অনৈতিক আচরণ প্রদর্শন করে থাকেন। দল ধরে মানুষ উত্যক্ত করে অন্য মানুষকে, অপশব্দ ব্যবহার করে নারী ও পুরুষদের, কিছু ব্যক্তিগত কারণে রঙিন হতে চান না যাঁরা। হোলি উদযাপনের নামে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নারীদের প্রতি খারাপ স্পর্শ ঘটেছে বহুবার বহু ক্ষেত্রে। সীমাহীন নেশা করা, অন্যদের মদ্যপান করতে বাধ্য করা ইত্যাদি তো আছেই। এমনকি সবচেয়ে খারাপ, নর্দমা থেকে নোংরা জল শুধুমাত্র মজা করার জন্য মানুষের উপর নিক্ষেপ করা হয়। এটাই কি এই হোলির উত্তরাধিকার?

রাক্ষস রাজা হিরণ্যকশিপুর ছোট বোন হোলিকা ব্রহ্মার কাছ থেকে বর পেয়েছিলেন যে আগুন তাকে পোড়াবে না। কিন্তু যদি সে কখনও এটির অপব্যবহার করে তবে বরটি অভিশাপে পরিণত হবে এবং আগুন তাকে ছাইয়ে পরিণত করবে। শুরু থেকেই বরং বলা যাক। বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে, জয় এবং বিজয়, বৈকুণ্ঠের দুই প্রধান নিরাপত্তা রক্ষী, নির্দোষ বালক ঋষি- সনক, সনন্দন, সনাতন এবং সনৎকুমারকে তাদের নিষ্কলুষতা এবং পবিত্রতার জন্য খারাপ রসিকতা করে অপমান করে যখন এই চার বালক ঋষি শ্রী হরি বিষ্ণু এবং দেবী লক্ষীর দর্শন প্রার্থনা করেন। এর জন্য এই দুই দ্বাররক্ষী অভিশাপ প্রাপ্ত হন।

অভিশাপ ছিল এই যে জয় এবং বিজয় উভয়কেই তিন বার অসুর রূপে জন্মগ্রহণ করতে হবে এবং প্রতিটি জীবনেই তাঁরা নিহত হবেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুর হাতে এবং পরিশেষে মুক্তি পাবেন।অসুর হিসাবে তাদের প্রথম জন্মে, জয় হয়েছিলেন হিরণ্যক্ষ এবং বিজয় হয়েছিলেন হিরণ্যকশিপু। ক্ষমতার ক্ষুধার্ত এবং আক্রমণাত্মক উচ্চাকাঙ্ক্ষী হিরণ্যক্ষ, যিনি সমগ্র পৃথিবীকে শাসন করতে এবং দাস করতে চেয়েছিলেন, বিষ্ণুর তৃতীয় অবতার বরাহ (শুয়োর) দ্বারা যুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, তার ছোট ভাই হিরণ্যকশিপু ভগবান ব্রহ্মার উপাসনা করেছিলেন এবং একটি বিপজ্জনক বর পেয়েছিলেন। ব্রহ্মার বিধান অনুসারে জন্মগ্রহণকারী কোন মানুষ বা পশু অবয়ব বিশিষ্ট প্রাণী তাঁকে দিনে বা রাতে, অস্ত্র দিয়ে বা অস্ত্র ছাড়া হত্যা করতে পারবে না, ভূমিতে নয়, ভূমির উপরেও নয়, ঘরের ভিতরেও নয়, বাইরেও নয়। কোনও রোগ তাঁর নিধন করতে পারবে না, বার্ধক্য তার মৃত্যুর কারণ হতে পারবে না। সংক্ষেপে, তিনি একটি বর পেয়েছিলেন যা তাঁকে এমন পরিমাণে অজেয় করে তুলেছিল যে তাঁর পরাভব অসম্ভব হয়ে উঠেছিল।

আরও পড়ুন: দোলের আগে তাপমাত্রার পরিবর্তন

এই দুই ভাই এর আরেকজন রাক্ষস বোন ছিলেন হোলিকা, তিনিও বর পেয়েছিলেন যা আমি আগে উল্লেখ করেছি। কিন্তু গল্পটি অন্য মোড় নেয় যখন হিরণ্যকশ্যপুর পুত্র প্রহ্লাদ ভগবান বিষ্ণুর প্রবল ভক্ত হয়ে ওঠে। হিরণ্যকশ্যপু তা সহ্য করতে পারেননি, কারণ বিষ্ণু ছিলেন তাঁর একমাত্র শত্রু, যিনি তাঁর বড় ভাইকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁর নিজের বিদ্রোহী পুত্রকে হত্যা করার জন্য অনেক চেষ্টা করার পর, অবশেষে ক্ষিপ্ত হিরণ্যকশিপু হোলিকাকে আদেশ দিয়েছিলেন প্রহ্লাদকে তাঁর কোলে নিয়ে জ্বলন্ত চিতায় বসতে। সবাই ভেবেছিল প্রহ্লাদ দগ্ধ হবে কারণ হোলিকা আগুন থেকে প্রতিরোধী ছিলেন। কিন্তু ঘটনা উল্টো হয়ে গেল। ভক্ত প্রহ্লাদ নিরন্তর ভগবান হরির নাম জপ করতে থাকেন, তাই অগ্নি তার ক্ষতি করেনি বরং হোলিকাকে ভস্মে পরিণত করেছিল।
এখন আমরা বুঝতে চেষ্টা করি যে বিষ্ণুপুরাণের রচয়িতা মহর্ষি বেদব্যাস কেন আমাদের এই গল্প বলেছেন। নিরলস ভক্তি অশুভ শক্তির উপর জয়লাভ করতে পারে তা মনে রাখার জন্য আমরা হোলিকা দহনকে প্রতীকের আচার হিসাবে উদযাপন করি। আমরা অহং-চালিত নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুক্তির প্রতীক হিসেবে রং দিয়ে একে অপরকে শ্রদ্ধা জানাই।

আমি জানি না কে এই আচারকে উত্যক্ত করা, কটূক্তি করা এবং নারী ও পুরুষের শালীনতার ক্ষতি করার মতো খারাপ বৈশিষ্ট্যের অনুশীলনে পরিণত করেছে, যাঁরা অন্যায়ভাবে রঙ দেওয়া পছন্দ করেন না। অভ্যন্তরীণ অর্থ পরিষ্কার না হলে ধর্মীয় আচারগুলি বিপজ্জনক হতে পারে। হিরণ্যকশিপুকে অবশেষে হরির চতুর্থ অবতার ভগবান নরসিংহের দ্বারা মৃত্যুদণ্ড পেতে হয়, যিনি একটি ভাঙা স্তম্ভ থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন, যিনি ব্রহ্মার বিধান অনুসারে জন্মগ্রহণ করেননি, যিনি অর্ধ সিংহ-অর্ধ পুরুষ, যিনি তাকে ঘরের ভিতরে এবং বাইরের মাঝখানে দরজার কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন সন্ধ্যার সময় যা দিন কিম্বা রাত নয়। তারপর নিজের জঙ্ঘার উপরে স্থাপন করে যা কিনা ভূমিতে কিম্বা আকাশ নয় এমন স্থানে, নখ দিয়ে উদর চিরে, বিনা অস্ত্রে তাঁর নিধন করে ছিলেন।

আরও পড়ুন: ঘরের মাঠে অঘটন, লজ্জার হার লাল হলুদের

মৃত্যুকে কেউ বুড়ো আংগুল দেখাতে পারে না, কেবলমাত্র সে ছাড়া যে কখনো জন্মায়নি। একমাত্র সর্বশক্তিমান পরমাত্মাই অজর এবং অমর। এই রাক্ষস নিধনকে আক্ষরিক অর্থে নিলে লেখকের গল্প বলার পুরো উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়। অসুর একটি অশুভ বৈশিষ্ট্য। অত্যাচার, মিথ্যা, নিপীড়নমূলক আচরণ ইত্যাদি হল আসুরিক বৈশিষ্ট্য যা ঋষি আমাদের এড়াতে বলেছেন বার বার। হিরণ্যক্ষ এবং হিরণ্যকশ্যপু উভয়েই ছিলেন ঋষি কশ্যপ এর পুত্র, অতএব ব্রাহ্মণ। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতে উচ্চ বর্ণের জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তির মধ্যে খারাপ আসুরিক বৈশিষ্ট্য থাকতেই পারে, ঋষি সেই কথাও বলছেন। যাঁরা দাবি করেন যে অসুররা অনার্য ছিল যারা আর্য আধিপত্যে নিপীড়িত হয়েছিল তারাও পুরাণ সম্পর্কে অসচেতন ঠিক তাঁদের মতোই যারা দেব এবং অসুরদের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব খুঁজে বের করার জন্য কার্বন ডেটিং করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে থাকেন। দেবতা ও অসুর উভয়ের গুণই আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। হিরণ্যকশ্যপু বা প্রহ্লাদ, আমরা কি হতে চাই? তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে আমাদের নিজেদের চয়নের উপরই।


এর পরের জন্মে জয় হয়েছিলেন রাবণ এবং বিজয় হয়েছিলেন কুম্ভকর্ণ, যাঁদেরকে শ্রী রাম যুদ্ধে নিহত করেছিলেন। পরবর্তী জন্মে তারা হলেন শিশুপাল এবং দন্তবক্র, যাঁরা নিহত হয়েছিলেন শ্রী কৃষ্ণের হতে। এরপর এই দুই ভাই নির্দোষ বালক ঋষিদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে বৈকুণ্ঠে পুনরায় ফিরে যান। রামধনু রঙের মত সমস্ত বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ এবং বিশ্বাস ব্যবস্থার জন্য সুখ পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল এই প্রকারে। অবাস্তব মনে হচ্ছে, তাই না? এটিই ঋষি ব্যাস আমাদের গ্রহণ করতে বলছেন বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীর মাধ্যমে- সমদর্শন। বিংশ শতাব্দীর বাংলায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হোলির আচার অনুষ্ঠান ব্যবহার করে সবার কাছে একই ধরনের শ্রদ্ধা ও সম্মেলন এর বার্তা ছড়িয়ে দিতে চান। সেসব ভুলে আমরা কদর্য রসিকতায় মেতে থাকি।

Related posts

Leave a Comment