দুবেলা: আমি নিশ্চিত আপনাদের অনেকেরই শেয়ার বাজারের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু কত জন সফল সে বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে। আপনারা যারা বিনিয়োগ করতে আগ্রহী তাদের জন্যে একটা রহস্যময় তথ্য দিলাম। জানেন কি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় অনায়াসে মুনাফা তোলা যায়। যদিও এই গেমে অন্যতম একটি মূলধন হল ধৈর্য্য। নাক মুখ বুঁজে যদি একটু ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে পারেন তা হলে আপনি অনায়াসে সম্পদ তৈরি করতে পারবেন সন্দেহ নেই। কী ভাবে বিনিয়োগ করা যায় আর তা কী হারে বাড়ে চলুন তার একটা নমুনা দেখা যাক।
বিনিয়োগের জন্য শেয়ার বাছাই (Stock Selection)
অ্যাকাউন্টে টাকা রয়েছে আর যেখানে খুশি বিনিয়োগ করে দিলাম এমনটা হলে চলবে না। এখানে শেয়ার নির্বাচন করতে পারবেন নিজেই। ঝাড়াই বাছাইয়ের জন্যে কোনও জটিল হিসেব নিকেশের দরকরার নেই। তা হলে কী করতে হবে। গোড়ায় একের পর এক শেয়ারের প্রাইস চার্ট খুলুন। এখানে একটু দীর্ঘমেয়াদে ভাবার জন্যে সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক চার্ট দেখাই ভাল। দেখুন অনেক সময় বেশ দামি দামি শেয়ারের দাম এক্কেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। তার পর দাম প্রায় একই জায়গাতে বছরের পর বছর এমনকি মাসের পর মাস ঘোরাফেরা করছে(নিচের ছবিতে দেখুন)। খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে শেয়ারের মূল্যমান অনেক কমে গিয়েছে। পরিস্থিতি হলে আবার দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অবধি খুঁজে পেয়েছেন মানেই আপনার অর্ধেক কাজ হাসিল। এবার চার্টের দিকে নজর দিতে হবে।
পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ (Investment Criteria)
চলুন, এবার আমরা পরিস্থিতির দিকে নজর রাখি। বিনিয়োগের জন্য সমস্ত শর্ত পূরণ হচ্ছে কি না সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে তো! আচ্ছা, আপনি নিশ্চই খেয়াল করেছেন চার্টে যখন দাম পড়ছিল তখন দাম একের পর এক লোয়ার লো ভেঙেছিল। ধারাবাহিকভাবে লোয়ার হাইও তৈরি হচ্ছিল(নিচের ছবিতে দেখুন)। এটা তো নিম্নগামী বাজারের প্রাথমিক শর্ত। বাজারে এই শর্ত না মেনে উল্টোটা যখন শুরু হয় তখনই দীর্ঘ মেয়াদে পজিশন নেওয়ার সময় আসে।
এ সময়ে কী কী খেয়াল করবেন? প্রথমত, দামের লোয়ার লো আর হচ্ছে না। অন্য দিকে শেষতম লোয়ার হাই পয়েন্ট অতিক্রম করে ওপরের দিকে দাম চলে গিয়েছে। অর্থাৎ, নিম্নগামী বাজারের দুটো শর্তই আর কার্যকর হচ্ছে না। তা হলে কি শেয়ারটির দাম এবার উল্টো পথে চলতে শুরু করবে? সেই অপেক্ষাতেই এবার আমাদের সজাগ হওয়ার পালা।
Figure 1সাপ্তাহিক চার্ট
ওয়েভ প্যাটার্ন মেনে সিদ্ধান্ত (Elliott Wave Pattern)
চলুন, আবার দামের একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন খুঁজে বের করার চেষ্ঠা করি। যেটি আসলে ইলিয়ট ওয়েভ থিওরি অনুযায়ী ইমপালস প্যাটার্ন। এক্ষেত্রে ইমপালস হলে আমরা দীর্ঘ মেয়াদে বাজারে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিতে পারি। কী এই ইমপালস? খেয়াল করে দেখুন দাম যখন কোনও একটি দেকে যাচ্ছে, দূর থেকে দেখলে মনে হয় একের পর এক ঢেউ যেন আছড়ে পড়েছে। দু-কদম এগেয়েছে তো আবার এক দফা সংশোধন হয়েছে। অর্থাৎ যে দিক থেকে এসেছে সেদিকে গিয়েছে। আবার ঢেউয়ের মতো বেগে এগিয়ে চলেছে। এই তরঙ্গগুলো যখন নিচ থেকে উঠছে, তখন যদি আমরা এক-দুই…করে গুণতে থাকি তা হলে কেমন হয়! এক লহমায় এক থেকে শুরু করে তরঙ্গ পাঁচ অবধি উঠেছে। তার মধ্যে দুই আর চার হল সংশোধিত তরঙ্গ। খেয়াল করলে দেখবেন, চার্টে দাম যখন কোনও একটি নির্দিষ্ট দিকে গতি পাচ্ছে তখন এই ছন্দ মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। তা সে ওপরেই যাক অথবা নিচে।
এবার আসুন ইলিয়ট ওয়েভ থিওরি অনুযায়ী ইমপালস কাকে বলে তা একটু জেনে নিই। আমরা দামের নির্দিষ্ট ট্রেন্ডে যে পাঁচটি ওয়েভ দেখলাম তা অবশ্যই একটি ইমপালসে থাকতে হবে। এ ছাড়া আরও কয়েকটি শর্ত রয়েছে। প্রথমত, ওয়েভ দুই কখনও ওয়েভ একের যেখানে শুরু সেই পয়েন্ট অতিক্রম করতে পারে না। দ্বিতীয়ত, ওয়েভ ২ এবং ৪ কখনই ওভারল্যাপ করবে না। আসলে এই পর্যায়ে দাম কখনই একই এরিয়াতে ঘোরাফেরা করতে পারে না। এবং শেষ শর্তটি হল, দূরত্বের হিসেবে ওয়েভ ৩ কখনই সব থেকে ছোট ওয়েভ হতে পারে না। আসলে ওয়েভ ১, ৩ এবং ৫ এই তিনটি ওয়েভের মধ্যে সাধারণত ওয়েভ ৩ দীর্ঘতম এবং শক্তিশালী ওয়েভ হিসেবে ধরা পড়ে। এই বেলা বলে রাখি, আর এন ইলিয়ট সাহেবের প্রকৃত থিয়রির মধ্যে এগুলো একটি ভগ্নাংশ মাত্র। তবে আমাদের এটুকু জানলেই আপাতত কাজ চলবে।
মুনাফা তোলার সহজ উপায় (Profitable Strategy)
এতক্ষণে নিশ্চই ভাবছেন এত শর্ত মেনে কী হবে? শর্ত পূরণ হলেই মোটা মুনাফা হতে পারে। তাই এতটুকুও ভুলচুখ হলে চলবে না। একটা সিদ্ধান্ত অনেক কিছু পরিবর্তন আনতে পারে। শেয়ার বাছাইয়ের পর তার দীর্ঘমেয়াদী(সাপ্তাহিক অথবা মাসিক) চার্টে ইমপালস হয়েছে কি না তা খেয়াল করতে হবে। অর্থাৎ, চার্টে নিচ থেকে যখন দাম ওপরে উঠছে তখন ইমপালসের সমস্ত শর্ত পূরণ হল কি না তা দেখতে হবে। যদি তাই হয়, তাহলে এবার নিচে নামতে পারে। কী রকম? দামের গতিতে সংশোধন(নিচের ছবিতে দেখুন)। এই সংশোধনে দাম পুরো ইমপালসের দূরত্বের অর্ধেকের বেশিও নেমে যেতে পারে। তাই বলে ওয়েভ এক থেকে পাঁচ অবধি গণনা যেখান থেকে শুরু হয়েছে তার নিচে দাম গেলে কিন্তু চলবে না। দামের এই গতিপথে অপেক্ষা করার পলা। এরপর দাম যখন ওপরের দিকে গতি পাবে, তখন আগের হাই অর্থাৎ ওয়েভ ৫ অতিক্রম করলেই বড় মুনাফার হাতছানি রয়েছে।
Figure 2ইমপালস/সাপ্তাহিক চার্ট
লক্ষ্য এবং ক্ষতির সীমা (Target and stop loss)
যে কোনও কাজের কোনও একটা লক্ষ্য থাকতে হবে তো! এখানে মুনাফা তোলার যেমন একটি নূন্যতম লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, ঠিক তেমনই ক্ষতি হলেও কতটা অবধি লোকসান নেওয়া যেতে পারে তারও একটি সীমা রয়েছে।
আগে দেখা যাক, দাম যখন আমাদের ওয়েভ পাঁচ অতিক্রম করে এগোতে থাকে তখন কী হয়। নিচের দিকে গণনার গোড়া থেকে ওয়েভ পাঁচের উচ্চতা অবধি যে দূরত্ব তার অনুপাতে সংশোধনের পর থেকে ১৬১ শতাংশ অবধি দাম পৌঁছতে পারে(ওপরের ছবিতে দেখুন)। অর্থাৎ সব কিছু ঠিক থাকলে ১৬১ শতাংশ দূরত্বে মুনাফা তোলা(Profit Book) যেতে পারে।
আর যদি শেয়ার কেনার পর তার দাম ক্রমে নিচের দিকে চলতে থাকে? একটু আধটু চড়াই উৎরাই দামের চলনের স্বাভাবিক নিয়ম। তবে অনেকখানি নেমে গেলে উদ্বেগের কারণ তো রয়েইছে। কী করা যেতে পারে! সংশোধনের যে নিম্ন বিন্দু, দাম তারও নিচে গেলে আর অপেক্ষা না করাই ভাল। ওখানেই লোকসান বেঁধে(Stop Loss) দিয়ে বিনিয়োগ থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। তবে সমস্ত হিসেব নিকেষ ঠিক থাকলে এরকম অভীজ্ঞতা খুব কমই হবে।
খেলার নিয়ম (Rules of the game)
এখানে নিয়মানুবর্তিতাই প্রধান নিয়ম। ছোট্ট একটা ভুল পদক্ষেপ বড় কোনও ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তাই এতটুকুও বিচ্যুত হলে চলবে না। এখানে বিনিয়োগের আগেও যেমন ধৈর্য্যশীল হতে হয়, ঠিক তেমনই বিনিয়োগের পরেও মুনাফা তোলার জন্যও ধের্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হয়। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার কোনও শর্টকার্ট উপায় এখানে নেই। সে কারণে গোড়াতেই নিজেকে প্রশ্ন করুন, একটা দীর্ঘ প্রতীক্ষা ধাতে সইবে তো? আরেকটা কথা। ঝুঁকি কমানোর জন্য একাধিক শেয়ারে সমপরিমান অর্থ বিনিয়োগ করা যেতে পারে। সবার আগে, নিজেকে চার্ট যাচাই করে দেখতে হবে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আর্থিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
শেষের কথা (Conclusion)
কেবলমাত্র অনুশীলন থেকেই দক্ষতা বাড়ে। আগ্রহ থাকলে আজই চার্ট দেখা শুরু করুন। শর্তগুলো যাচাই করে দেখুন তো সব কিছু মেলে কি না! দীর্ঘ দিন ধরে তলানিতে দাম পড়ে রয়েছে এরকম শেয়ার আপনি অনেক খুঁজে পাবেন। তারপর কোম্পানিটি ঠিকঠাক কি না সেটাও একবার দেখে নিতে পারেন। এরপর দাম লোয়ার হাই বিন্দুকে অতিক্রম করার অপেক্ষা। এবার ইমপালস যদি হয় তার পরবর্তীতে সংশোধন। সংশোধন অবশ্যই গণনা যেখান থেকে শুরু হয়েছে তার নিচে যাবে না। দাম নিচে গেলে ওই চার্ট বাতিল করে অন্য একটি চার্ট খুঁজুন। আর দাম ওপরে গেলে কী হয় পরীক্ষা করে দেখুন। আগ্রহ থাকলে চার্ট দেখার অভ্যেস বজায় রাখুন। ওহ্ হ্যাঁ, কোনও পরিভাষা বুঝতে ঢোঁক গিলতে হলে একবার গুগুলের সাহায্য নিতে পারেন। আসলে যা অনেকেই জানেন, তা নিয়ে বেশি কথায় যাইনি। তারপরেও হোঁচট খেলে স্বচ্ছন্দে কমেন্ট করুন। কমেন্ট বক্স আপনার জন্য ফাঁকা রইল।
সতর্কীকরণ(Disclaimer)
এই নিবন্ধটি কেবলমাত্র শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে লেখা এবং এটি কোনও আর্থিক পরামর্শ প্রদান করে না। বাণিজ্যিক লেনদেন এবং বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকে, বাজারে ঘটে যাওয়া ঘটনা ভবিষ্যতের সম্পর্কে নিশ্চিত কোনও পূর্বাভাস দিতে পারে না। লেখক এবং দুবেলা যেকোনও ধরনের আর্থিক ক্ষতি বা অন্য কোনও ক্ষতির জন্য দায়ী নয়। আর্থিক পরামর্শের জন্য পাঠক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
Image Source: tradingview.com