আমরা আন্দোলনে মেতে আছি কেন ?

Spread the love

 

সৌমিক চ্যাটার্জী, মুখ্য সম্পাদক, দুবেলা

দুবেলাঃ বোধনের আগে শোনা যাচ্ছে বিসর্জনের বিষাদের সুর। আশঙ্কা, বিচারের বাণী হয়ত আরো একবার নীরবে কেঁদে যাবে কানা গলির প্রান্তে। তবুও শহরে যানযটের ঘনঘটা। মিছিলের দিকে ছুটে আসছে ভিন্ন ভিন্ন মতামত। আমরা এখনও আন্দোলনে আছি। ধৈর্য চুত্যির উপাদান থাকলেও। আন্দোলনের ভার কিছু কম হলেও, মরচে ধরেনি বিচারের গণদাবীতে।

তিলোত্তমার মাথার ওপর ভাদ্রের রোদ এখন। অকিঞ্চিত বৃষ্টি ধুয়েছে জাস্টিসের দেওয়াল লিখন । রাজপথের গ্রাফিটিরাও ফিকে হয়েছে কোথাও কোথাও।

উত্তর আধুনিক সমাজ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেছে । তার এখন আর কোন গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ নেই। একুশ শতকের পৃথিবীতে শ্রেণী চরিত্র নির্ধারণ করা, শুধু মুশকিল নয়, প্রায় নামুমকিন। ফলত শ্রেণী বিপ্লবের কোন সম্ভাবনাও নেই। বিশ্বায়ন উত্তর সমাজে সত্বা বৈশিষ্ট্যের রাজনীতি যতটা প্রখর, অর্থনীতির রাজনীতি ততটা নয়। সুতরাং, যে কোন সংগঠিত প্রতিবাদের বিশ দাঁত নড়বড়ে, কিঞ্চিত ফোঁস করে থমকে যাওয়াই, তার ভবিতব্য। শাসক সে সব কথা ভাল করেই জানে। তবুও তার দমন পীড়ন অব্যাহত। আর আমরা আন্দোলনে মেতে আছি। কেন ?

আমাদের এই আন্দোলনে মেতে থাকার কিছু দায় আছে। আমরা আন্দোলনে আছি অনুতাপে, পাপবোধ থেকে। আর জি করের ঘটনা, কেবলই এক সপাট অনুঘটক। যার থাপ্পড় ও পরবর্তী অনুরণন আপাতত থামেনি। সামাজিক ভূমিকম্প চলছে। তাই আমরা আন্দোলনে আছি।

গণ আন্দোলনের ইতিহাস যে সবসময় খুব ফলপ্রসু ও সফল, এমন নির্মম প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। এ ধরনের আন্দোলন সাধারণত কোন লক্ষ্য কে সামনে রেখে পথ চলেনা। যারা এখনও পথে নামছেন, তারা শুধু বিরুদ্ধতা করবেন বলেই , একজোট হচ্ছেন। গণ আন্দোলন , চরিত্র গত ভাবে কোন কিছুর বিপক্ষে হয়, পক্ষে নয়। বলাই বাহুল্য, যে কোন গণ আন্দোলন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এবং শাসন যন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অবস্থানের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আঙ্গিক।

একাধিক আনুষঙ্গিক কারন থাকতে পারে এই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার পেছনে। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের জনগণ যে উদ্যোম দেখিয়েছেন সাম্প্রতিক অতীতে এবং সেই অভ্যুত্থান তাদের দেশের শাসন যন্ত্র কে যতটা পর্যদুস্ত করেছে, তা দেখে আমরা হয়ত অভিমানী হয়েছি- ওরা পারলে আমরা কেন নয়? হয়ত আন্দোলনে মেতে থাকার এটা একটি কারণ। এমন আস্ত একটা ফেনোমেনা, বর্তমান বাঙালি সমাজ সাম্প্রতিক অতীতে অভিজ্ঞতা করেনি। তাই আন্দোলন ও চলছে এবং তাকে কেন্দ্র করে সমাজ মাধ্যমে উঠছে ছবি চালাচালির কাল বৈশাখি। অসময়ে। হয়ত, গণমাধ্যম এই আন্দোলনের পন্য মুল্য খুঁজে পেয়েছে । আর জি কর হাসপাতালের নির্যাতিতার বিচার চেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে গড়ে ওঠা আন্দোলনের খন্ড চিত্র টিআরপি বাড়াতে সাহায্য করছে। তাই আমরাও মেতে আছি আন্দোলনে, হয়ত। হয়ত আমরা মিছিল থেকে ন্যায় বিচার চেয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার অপেক্ষায় আছি।

তবুও, আমাদের খন্ডিত গোষ্ঠী, লিঙ্গ, সাংস্কৃতিক, আর্থিক সামাজিক ও ভাষাগত আলাদা আলাদা সত্বাবৈশিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও আমরা একসাথে আন্দোলন আছি। এই টুকরো হয়ে থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিরাপত্তার অভাব বোধ আর বঞ্চনার সাতকহন, আমাদেরকে মালার মত এক সাথে গেঁথে রেখেছে । আমাদের ক্ষতগুলো ব্যক্তিগত হলেও ,তাদের করন গুলো আসলে আর্থিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক । ভবিষ্যত ও ফলাফলের চুলচেরা হিসাব না করেই আমরা তাই আন্দোলনে মেতে আছি। এখনও।

মাঝ দরিয়ায় তরঙ্গ তৈরি হলে, অপেক্ষায় থাকে জলরাশি, সে তরঙ্গ বয়ে বেড়াবে বলে। স্বভাবতই তরঙ্গের আরেক নাম আন্দোলন। ঢেউ গুলো অবস্থান বদলায়। ছিটকে আসে পাড়ের কাছাকাছি। সে জলোচ্ছাস কিছু ইমারত ভাঙে। টেনে নিয়ে যায় গড্ডালিকার নুড়ি পাথর। শূন্যতা তৈরি হয়, নতুন করে জনপদ গড়ে উঠবে বলে। ধ্বংসাবশেষ এর ওপর দাঁড়িয়ে নাগরিক অপেক্ষা করে বিকল্প নির্মাণের। আমরা তাই আন্দোলনে মেতে আছি। কারণ আমাদের অনেকের কাছে, এছাড়া কোন বিকল্প নেই।

ছবিঃ  মদনমোহন সামন্ত

Related posts

Leave a Comment