কতটা পথ পেরোলে

Spread the love
সৌমিক চ্যাটার্জী, মুখ্য সম্পাদক, দুবেলা

দুবেলাঃ সেদিন বৃষ্টি ভেজা অফিস টাইম। তার সঙ্গে ভিন্ন রাজ্যের বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলের তোড়জোড়। যান বাহন বিমুখ শহরে ,আমার মত ছাপোষা শিক্ষকের হলুদ ট্যাক্সিই ভরসা। বেয়াড়া ভাড়া চাওয়ায় তাদেরকেও ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি। এমন সময় এই নীল গেঞ্জি পরা বীর পুরুষের আবির্ভাব। ” স্যার, কোথায় যাবেন?” – এক ট্যাক্সি ওয়ালার মিতভাষ সম্বোধনে খটকা লাগে, তবে আমাদের দরদাম মিলে যাওয়ায় ট্যাক্সিতে চড়ে বসি। ভাড়া নিয়ে বচসা নেই , ভদ্র ব্যবহার- এ তো উগ্রবাদের মরুভূমিতে এক ফোঁটা শান্তির জল। তবে ” স্যার” সম্মোধনের তাৎপর্য তখনও বুঝিনি। কেউ যদি “স্যার” বলে সম্বোধন করে , তাতে তো ভালোই লাগে। আমি লক্ষ্য করেছি এক ধরনের লোক ট্যাক্সির চালক কে “এই ট্যাক্সি যাবি? ” বলেন। যেন চালকদের নাম “ট্যাক্সি” । আর নিজেদের শ্রেণী অবস্থানের কারণে ধরেই নি ভদ্র ব্যবহার ও আনুগত্য গ্রহনে আমাদের জন্ম গত অধিকার। ছেলেটির নাম ট্যাক্সি নয়, সোমনাথ দাম । পেশায় ট্যাক্সি চালক।

সোমনাথ 2022 সালে কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে স্নাতক হয়েছেন। সাম্মানিক ইংরেজি সাহিত্য ছিল তার বিষয়। সোমনাথ 2024 সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি নিয়ে MA পাশ করেন। NET এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন গবেষণা করবেন বলে। এই সময়ে ওনার বাবা কিডনির অসুখে আক্রান্ত হন। একবছর সোমনাথ কোন স্থায়ী চাকরি যোগাড় করতে পারেননি। অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে পাড়ার একটি বেসরকারী স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। বেতন ছিল আট হাজার টাকা। বাবার অসুখের, সংসারের খরচ যোগাড় করতে পারেন না। অতঃপর সিদ্ধান্ত নেন বাবার বসে যাওয়া ট্যাক্সিটা চালিয়ে উপার্জন করবেন। পার হতে হবে যে। সোমনাথ তার মা বাবাকে নিয়ে আগরপাড়ায় থাকেন।

সোমনাথ, বাঙালি, বাঙলায় থাকেন। রাষ্ট্র যে তার সঙ্গে বেইমানি করেছে হয়ত তিনি সেটা বুঝতে পারেন নি। কলেজের অধ্যাপক, যিনি দেশে বিদেশে সেমিনার করে বেড়ান আর মাস গেলে কলেজের এই প্রান্তিক ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানো বাবদ মোটা সরকারী বেতন পান, তিনিও সোমনাথ কে মনে রাখেন নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ত খেদ .প্রকাশ করেছেন সোমনাথের ভুল ফরাসী উচ্চারণের জন্য , দায় নেন নি। স্পিভাকের সাথে হয়ত সোমনাথের কোন দিন দেখা হবে না। দেরিদার বিনির্মানের ব্যখা তার পড়া হবে না। তবে আজকের Post Trurth সমাজে সম্ভাবনা আছে একদিন সোমনাথ ফেসবুকে MA Taxiwala হয়ে যাবেন। মিডিয়ার সন্ধা আসরে সোমনাথরা কোনদিন থাকবেন না, পাবেন না আনন্দ পুরস্কার। তবু ও রোজ তার ট্যাক্সি ছুটবে, অযান্ত্রিক, সওয়ারীদের গন্তব্য থেকে গন্তব্যে, সোমনাথ দের সফরনামা থামবেনা….

সোমনাথের Graduation পরীক্ষার সিট বার দুয়েক আমার কলেজে পড়েছিল। পরীক্ষার হলের দায়িত্বে আমি ছিলাম। সোমনাথ মনে করাল। সে আমায় চিনতে পেরেছিল। আমি তাকে চিনতে পারিনি।
ভালো থেকো কমরেড , তুমিই আমার চে গুয়েভারা, আমার হিরো.

Related posts

Leave a Comment