
মহাভারত বললেই সবার প্রথমে মনে পড়ে গান্ডিবধারী অর্জুনের কথা, যে বাল্যকালে গুরু দ্রোণাচার্যের আশ্রমে প্রথমে পাখির চোখ, দ্রৌপদীর সয়ম্বর সভায় মাছের চোখ এবং রনভূমি কুরুক্ষেত্রে শত্রুর মাথা ভেদ করেছিল। কিন্তু আরও একজন তিরন্দাজের কথা আজ বলবো যে এমন এক লক্ষ্যভেদ করেছিল যা আর কেউ পারেনি। না, আমি ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ কিম্বা একলব্যের কথা বলছি না। আমি বলছি জরা নামক ব্যাধের কথা যে হরিণের মাথা ভেবে বিষ মেশানো তির দিয়ে বিদ্ধ করেছিল স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণকে, যা কিনা তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়।
না, ঠিক এটাও মূল কারণ নয়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সমাপ্তির পর মহারানী গান্ধারী তাঁর শতপুত্র হত হবার শোক সামলাতে না পেরে শ্রীকৃষ্ণকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, “হে, দেবকিনন্দন, যে ভাবে আমার পুত্ররা নিহত হলো, ঠিক একই ভাবে তোমার সামনে তোমার যদুবংশ নাশ হবে। তুমি দেখেও কিছু করতে পারবে না। তুমি চাইলে এই নর সংহার আটকাতে পারতে, কিন্তু তুমি হতে দিলে। হে কৃষ্ণ, তোমার ও একদিন হত্যা হবে।”
মায়াপতি পালনহার, যাঁর ইচ্ছায় সকল বরদান এবং অভিশাপ পূর্ণ হয়, শুনে বললেন, “হে মাতা, তথাস্তু:।”
মহাভারতের মুষল পর্বের আক্ষ্যান অনুযায়ী সকল যাদবরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরে গেলো। হঠাৎ একদিন সুভদ্রা তাঁর একমাত্র পুত্র অভিমন্যুর কথা ভাবতে ভাবতে শোকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন এবং শ্রীবলরাম সমুদ্রের তীরে এসে ধ্যাণমুদ্রায় নিজের পার্থিব দেহ ত্যাগ করে আদি অনন্ত শেষণাগ রূপে সমুদ্রে মিলিয়ে গেলেন। এই দৃশ্য দুর থেকে দেখে, ব্যথিত, ক্লান্ত শ্রীকৃষ্ণ হাঁটতে হাঁটতে একটি গাছের নিচে এসে বসলেন বিশ্রাম করতে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই জরা ব্যাধের নিক্ষেপ করা তির এসে বিঁধল তাঁর পা এ।
জরা কাছে এসে বললো, “এ আমি কি অনর্থ করলাম? আমি হরিণ এর মাথা ভেবে শ্রীকৃষ্ণের পা এ তির মারলাম? হে প্রভু, আমি বুঝতে পারিনি দুর থেকে। আমাকে ক্ষমা করুন, নয় শাস্তি দিন।”
উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ” হে জরা, তোমার কোনো দোষ নেই। আমিই তোমার বানের প্রতীক্ষায় এখানে বসেছিলাম। আমার এই অবতারের কাজ সমাপ্ত হয়েছে, এবার এই দেহত্যাগ করে আমার নিজধাম বৈকুণ্ঠে ফেরার সময় এসেছে। আমার ইচ্ছাতেই এই সব হয়েছে। তোমার কোনো দোষ নেই। তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও।”
কিন্তু জরা কিছুতেই শ্রীকৃষ্ণের এই আপ্তবাক্য মানতে চাইলো না। উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে জরা, শোনো তবে। পূর্ব জন্ম তুমি ছিলে বানর রাজ বালী, আর আমি ছিলাম শ্রীরাম। আমার পূর্ব জন্মে একটিই গর্হিত অপরাধ ছিল। আমি আড়াল থেকে শরসন্ধানে তোমাকে সংহার করেছিলাম। আমার সেই অপরাধের শাস্তি স্বরূপ এই জন্মে তুমি আমাকে আড়াল থেকে সংহার করলে। কর্মের বিধান থেকে কেউ মুক্ত নয়। তোমরা আমাকে ঈশ্বর রূপে দেখো। কিন্তু এর থেকে আমি নিজেও মুক্ত নই যে। আমার নিয়ম যদি আমিই না মানি, অন্যেরা মানবে কেনো? তাই এই হলো। এবার তুমি যাও।”
এই কথাও জরা ব্যাধের জন্য যথেষ্ট হলো না। সে হাত জোড় করে বললো – “আমি আপনার দর্শন পেলাম, কিন্তু এই ভাবে, এই অবস্থায়। আপনার সেবা করার কোনো সুযোগ যে পেলাম না। আপনি আমাকে আপনার সেবা করার সুযোগ দিন। চলুন আপনাকে বৈদ্যের কাছে নিয়ে যাই।”
শ্রীকৃষ্ণ মুচকি হেসে বললেন, “আর বৈদ্যের কাছে গিয়ে কিছু হবে না। তোমার তিরের বিষ আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু তোমার এই বিনয়ে আমি সন্তুষ্ট। অতএব হে জরা, আমি তোমায় বর দিচ্ছি, কলিযুগে আমি উৎকলে দারুব্রহ্ম জগন্নাথ রূপে অবস্থান করবো। আর আমার জন্য অন্নভোগ রান্নার অধিকার একমাত্র তোমার বংশধরদেরই থাকবে। আমি নিত্য তোমার পরবর্তি প্রজন্মের থেকে সেবা নেব। তথাস্তু:।”
এই বলে শ্রীকৃষ্ণ প্রাণত্যাগ করলেন। তাঁর শরীর থেকে দিব্য আভা নির্গত হয়ে মিলিয়ে গেলো। পড়ে থাকলো কেবল প্রাণহীন শরীর।
এদিকে হস্তিনাপুরের পাণ্ডবরা কৃষ্ণের মৃত্যুর খবর পেলেন। অর্জুন ছুটে গেলেন দ্বারকায়। শ্রীকৃষ্ণ, বলভদ্র এবং সুভদ্রা তিনজনের দেহ নিমকাঠের চিতায় সাজিয়ে অন্ত্যেষ্টি করলেন। সব পুড়ে ছাই হলো, কেবল পুড়ল না শ্রীকৃষ্ণের হৃদয়। বরং সেটি একটি কঠিন নীল আভা বিশিষ্ট পাথরে পরিণত হয়ে গেলো। অর্জুন সেটি সঙ্গে করে হস্তিনাপুরের নিয়ে এলেন। এই রত্নের নাম হলো নীল মাধব, শ্রীকৃষ্ণের অন্তিম দেহাবশেষ।
এর বহু বছর পরে, উৎকলের (বর্তমান ওড়িশা) রাজা ইন্দ্রদুমন্যের পৃষ্ঠপোষকতায় পুরী ধামে সমুদ্রের তীরে মন্দির এবং নিমকাঠের বিগ্রহ নির্মাণ হয়। মহারাজের সভার পন্ডিত বিদ্যাপতি জঙ্গলের ভিতরে এক আদিবাসী সম্প্রদায়ের থেকে নীল মাধব উদ্ধার করেন এবং তা জগন্নাথের বিগ্রহের ভিতরে স্থাপন করেন। নীল মাধব কি ভাবে হস্তিনাপুর থেকে এতো বছরের যাত্রা করে ওড়িশার জঙ্গলে এসে উপস্থিত হলো, এ নিয়ে না না লোকগাথা আছে, এই নিয়ে বিস্তারিত পরে কখনও বলা যাবে। কথিত আছে, নিমকাঠের বিগ্রহ স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা অনন্ত মহারানা ছদ্মনামে এসে কুড়ি দিনে নির্মাণ করেছিলেন। বিগ্রহ তিনটি অসম্পূর্ণ থেকে যায় কারণ শিল্পীর একটি শর্ত রাজা লঙ্ঘন করেছিলেন। শর্ত ছিল এই যে যতদিন বিগ্রহ নির্মাণ চলবে ততদিন মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকবে। রাজা বা তাঁর কোনো পাঠানো ব্যক্তি মন্দিরের দরজা খুলতে পারবেন না।
প্রথম আঠারো দিন রাজা তাঁর মহল থেকে বিগ্রহ নির্মাণের শব্দ শুনতে পেলেন। উনিশতম দিন কোনো শব্দ তিনি শুনলেন না। কুড়িতম দিনে রাজা ধৈর্য্য রাখতে না পেরে মন্দিরের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু তিনি অনন্ত মহরানাকে আর সেখানে দেখতে পেলেন না। দেখলেন রত্নবেদীর উপর অসম্পূর্ণ তিনটি বিগ্রহ। সেই থেকে জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহের কোনো হাত নেই।
সত্যিই তো, কলিযুগে ভগবানের হাত নেই। না হলে তাঁকে নিয়ে রাজনীতি তিনি কি আর হতে দিতেন? মহাভারতে ছিল এক রকম রাজনীতি, আর এই ভারতে আরেক রকম।
তিনি শুধুই দেখে যাচ্ছেন, আর কি ভেবে মুচকি হাসছেন, শুধু তিনিই জানেন!

প্রতিমুহূর্তের খবর পেতে লাইক করুণ II দুবেলা নিউজ